আমার নাম আভা। আমার বয়স ৩৩ বছর। আমি একটা হাসপাতালে নার্স হিসেবে চাকরি করি। প্রতিদিন আমাকে রোগীদের সেবায় দিনের একটা লম্বা সময় কাটাতে হয়। দিনের ডিউটিতো থাকেই কখনো কখনো রাতেও ডিউটি করতে হয়। এতকিছুর পরেও আমার এই কাজটা ভাল লাগে। কারণ এখানে মানুষের সেবা প্রত্যক্ষভাবে করা যায়। গত বছর পর্যন্তও আমার রিলেশনশীপ স্ট্যাটাস সিংগেল ছিল। তাই কাজ বাদে আমার কাউকে যেহেতু সময় দেওয়ার ছিল না। তাই সারাদিন ইচ্ছেকৃত কাজকেই বেশি সময় দিতাম। এমনকি ওভার টাইমও করতাম। যাতে সময় কাটে। ফলে যেটা হোতো তা হচ্ছে, প্রচন্ড ক্লান্ত বোধ হোতো কাজ শেষে। ছুটি পেলেই আমি আমার মায়ের সাথে দেখা করতে যেতাম। আমার মা গ্রামে থাকে। আমার জীবনটা খুব সহজ ও স্বাভাবিক ছিল।
একদিন একটা পরিবর্তন আসলো। আমাদের হাসপাতালে নতুন এক ডাক্তারের পোস্টিং হোলো। ডাক্তারের নাম ছিল মাহির। সে আমার থেকে দুই বছরের ছোট ছিল জানতে পারলাম। তবে সে খুব সুদর্শন ছিল। তার ব্যবহার অমায়িক ছিল এবং সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল মুখ। ফলে সব ডাক্তার, নার্স এবং হাসপাতালের কর্মচারীরা তাকে অনেক পছন্দ করতো। আমাদের হাসপাতালে এত্ত সুন্দরী সুন্দরী নার্স আছে যে তাদের মধ্য থেকে মাহির আমাকে খেয়াল করবে এটা আমি ভাবিওনি কখনো। আমি আর ১০টা সাধারণ মেয়ে যেভাবে চলাফেরা করে ও পোশাক পরে আমিও ঠিক তেমনি ছিলাম। কিন্তু মাহির আমার সাথে ধীরে ধীরে কথা বলতে শুরু করলো। প্রতিদিনই সে আমার সাথে দেখা হলে হাসিমুখে ভাল মন্দ জিজ্ঞেস করতো। মাহিরের একটা বাইক ছিল। সে প্রতিদিন সেটাতেই করে হসপিটালে আসা যাওয়া করতো।
একদিন আমাদের ডিউটি একসাথেই শেষ হলো। আমি আমাদের হসপিটালের ঠিক উল্টোপাশে যে যাত্রী ছাউনিটা ছিল সেখানে দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষা করছিলাম। ঠিক তখনি মাহির আমার সামনে তার বাইকটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে বললো আপনি চাইলে আমি আপনাকে বাড়ি পৌছে দিতে পারি। আমিও আপত্তি করলাম না। আমি তার বাইকে উঠলাম। চলার পথে আমাদের বেশ কথাও হোলো। নিজেদের কাজ, পরিবার এসব নিয়েই পুরো পথ আমাদের কথা হোতে থাকলো। আমার কেন জানি মাহিরের সাথে কথা বলতে বেশি জড়তা লাগেনি। এরপর থেকে প্রায়ই আমি মাহিরের সাথে যাতায়াত করতে লাগলাম। আমরা কখনো কখনো চলার পথে কোনো কফি শপে দাঁড়িয়ে কফি খেতে খেতেও গল্প করতাম। এভাবে আমি ধীরে ধীরে পছন্দ করতে শুরু করলাম। আমি তার সাথে রোজ যাতায়াতের জন্য আর দেখা করার জন্য রোজ অপেক্ষা করে থাকতাম।
হঠাৎ একদিন মাহির বলে বসলো, ‘আমার তো আগামীকাল অফ ডে। তোমার কি ডে অফ আছে আগামীকাল?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, কেন?’ মাহির বললো, ‘আগামীকাল আমরা সারাটা দিন একসাথে কাটাতাম। ঘুরব, খাব, মুভি দেখব। এইসব আর কি।' আমি মনে মনে অনেক খুশি হলাম এবং রাজি হয়ে গেলাম।
পরেরদিন কথা মত আমরা পুরোটা দিন একসাথে কাটালাম। খুব সুন্দর একটা দিন কাটালাম। রাত ৯টার দিকে মাহির আমাকে আমার বাসার সামনে নামিয়ে দিলো। আমার কয়েকজন নার্স কলিগ মিলে আমরা একটা ফ্লাট নিয়ে থাকি। আমি আমার রুমে ঢুকে ভাবলাম মাহিরও বোধহয় আমাকে পছন্দ করতে শুরু করেছে।
এর কিছুদিন পর মাহির আমাকে একটা কথা বললো। যা শুনে আমি রীতিমত আকাশ থেকে পড়লাম। মাহির আমাকে বললো, সে বিবাহিত। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম সে আমাকে একবারও বলার প্রয়োজন বোধ করেনি যে সে বিবাহিত। বিবাহিত মানুষের কিছু না হোক একটা আংটি অন্তত থাকে সচরাচর। তার হাতে তাও ছিল না। সহজ করে বলতে গেলে সে বিবাহিত এটা বোঝার কোনো উপায়ই ছিল না। সে আরও বললো, তার বিয়ে হয়েছে ৫ বছর হোলো। তার ওয়াইফের নাম লিজা। তাদের কোনো সন্তান নেই। এমনকি তাদের দাম্পত্য জীবনেও কোনো সুখ নেই। তাদের মন বা পছন্দের কোনো মিল না থাকায় তারা একসাথে বা অন্তরঙ্গ কোনো সময়ই কাটায় না। সে আমাকে খুব পছন্দ করে। তার আমার সাথে সময় কাটাতেই বেশি পছন্দ। ঠিক ঐ মুহুর্তে আমার ঠিক কি করা উচিত বুঝতে পারছিলাম না। আমি এর মধ্যে মাহিরকে ভালবেসে ফেলেছি। কিন্তু আমি তার জীবনে কোনো সমস্যা করতে চাই না। আমি শুধু বললাম, ‘আচ্ছা, আমাকে একটু ভাবতে দাও।'
আমি বাসায় এসে শুধু ভাবতে থাকলাম একটা বিবাহিত মানুষ কিভাবে আমার সাথে স্বম্পর্ক করতে চাইতে পারে? এরপর থেকে আমি ভাবতেই থাকলাম এটা ওটা নিয়ে। আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম এটা নিয়ে যে আমার আসলে কি করা উচিত, অন্তত তার সাথে কথা বলা চালিয়ে যাওয়া উচিত নাকি সেটাও বন্ধ করে তাকে এড়িয়ে চলা উচিত? আমার মস্তিষ্ক বলছিলো তাকে এড়িয়ে চলা উচিত। আবার মন বলছিলো আমার জীবনে আমি প্রথম কারো প্রেমে পড়েছি তাকে ছাড়া আমার চলবে কি করে? এর মধ্যে বলে রাখা ভাল, যেদিন মাহির আমাকে এই ঘটনাটা বলেছিল, তার পরের দিনটা আমি ডিউটি করেছিলাম। ডিউটি করে ৩ দিনের ছুটি নিয়েছিলাম। যেদিন ডিউটি করেছিলাম ঐ দিনটা আমি মাহিরকে প্রায় এড়িয়েই ছিলাম। মাহিরও আমাকে দেখলেও কিছু বলেনি। শুধু তাকিয়ে থাকতো।
যাই হোক, এই ছুটি নেওয়ার শেষের দিন আমি একটা শপিং মলে কিছু শপিং করতে। ভেবেছিলাম, শপিং করলে হয়তো একটু ভাল লাগবে। শপিং মলে যখন শপিং-এর জন্য ঘুরে ঘুরে দেখছি, হঠাৎ একটা পরিচিত স্বর ভেসে আসলো। আমি ফার্স্ট ফ্লোর থেকে তাকিয়ে দেখলাম গ্রাউন্ড ফ্লোরে মাহির একটা মহিলার সাথে কথা বলছে। আমি ধারণা করলাম, এটাই মাহিরের ওয়াইফ লিজা। লিজাকে দেখতে অসম্ভব সুন্দর। অনেক দামী একটা শাড়ি পড়ে আছে। পুরো একটা মডেলের মতই লাগছে। সে আর মাহির খুব হেসে হেসেই কথা বলছে। তাদেরকে দেখে অনেক সুখি মনে হোলো। এটা দেখে আমার খুব কষ্ট হোলো। কষ্ট হয়েছিলো এজন্য না যে তাদের সুখি মনে হচ্ছিলো, বরং কষ্ট হয়েছিলো এটা ভেবে যে মাহির আমাকে এত বড় মিথ্যা বলেছিলো যে সে সুখি নয়। আমি আর এক মুহুর্তে সেখানে অপেক্ষা করতে পারিনি। আমি শপিংমল থেকে বেরিয়ে আসলাম এবং সোজা আমার বাসায় চলে আসলাম। হ্যাঁ, এটাও সত্য আমি মাহিরকে এতটাই ভালবেসে ফেলেছিলাম যে তার সাথে অন্য কোনো মহিলা বা মেয়েকে দেখলে আমার জেলাস ফিল হোতো। আমার আসলেই কি করা উচিত বুঝতে পারছিলাম না। এত আবোল তাবোল চিন্তা মাথায় আসছিলো ঐ রাত আমার ঘুমই হোলো না।
পরের দিন, আমি হসপিটালে গেলাম। আমার ছুটিও শেষ। ঘুম হয়নি বলে খুব ক্লান্ত লাগছিলো। আমার এতসবের পর মাহিরের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। কিন্তু কিছু করার ছিল না একসাথে ডিউটি করতে গেলে কথা তো বলতেই হবে। সে আমাকে দেখে হাসিমুখে কেমন আছো জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু আমার জবাব দিতে ইচ্ছে হোলো না। এভাবে বেশ কিছুদিন চলতে থাকলো। আমি আর পারছিলাম না। অবশেষে, আমি আমার সবচেয়ে কাছের কলিগ সাজিয়াকে সব খুলে বললাম। আমি জানতাম না সাজিয়া আমাকে মাহিরের সাথে মেলামেশা নিয়ে খেয়াল করছে। সাজিয়া বললো, ‘আভা, তুই যখন থেকে মাহিরের সাথে ঘনিষ্ঠ হচ্ছিস বুঝলাম। আমি মাহির স্বম্পর্কে খোঁজ নিতে শুরু করলাম। মাহির যা বলেছে তা মিথ্যা তার দাম্পত্যে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তার মেয়েদের প্রতি আকৃষ্টতা বা মাখামাখি করার প্রবণতা বেশি। আগে যেখানে ছিলো সেখান থেকেও মেয়েলি কারণে তার ট্রান্সফার হয়। কিন্তু আমি কিভাবে তোকে বলব, তুই বিশ্বাস করবি কি না আমি বুঝতে পারছিলাম না।' এটা জানার পর আমার মাহিরের প্রতি আর কোনো আগ্রহ যে থাকবে না এটা নিশ্চয়ই আর বলা লাগবে না? কিন্তু আমি আর ওকে দেখতেও চাচ্ছিলাম না। আমি কয়েকদিন ধরে চেষ্টা করে ঐ হসপিটাল থেকে ট্রান্সফার নিলাম। আর শিখলাম, জীবন আমাদের অনেক সুযোগ দেয় এবং ভবিষ্যতেও দেবে। আমাদের ওগুলো থেকে যেটা আমদের জন্য সবচেয়ে ভালো সেটা বেছে নিতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন